Skip to content

উত্তর প্রদেশে বেকায়দায় বিজেপি, ফিরছে ‘মণ্ডল’ রাজনীতি

    বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে উত্তর প্রদেশে আবারও বড়সড় ধাক্কা খেল বিজেপি। সম্প্রতি দলের শীর্ষ নেতা ও রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী স্বামীপ্রসাদ মৌর্য সমাজবাদী পার্টিতে (এসপি) যোগ দিয়েছেন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল বৃহস্পতিবার বিজেপি ছাড়লেন উত্তর প্রদেশের খাদ্যনিরাপত্তামন্ত্রী ধর্ম সিং সাইনি। গত তিন দিনে তিনি তৃতীয় মন্ত্রী, যিনি বিজেপি ত্যাগ করলেন। একই সঙ্গে বিজেপি ছেড়েছেন পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদের বিধায়ক মুকেশ শর্মা। তাঁদের নিয়ে বিজেপি-ত্যাগীদের সংখ্যা দাঁড়াল আট।বিজ্ঞাপন

    রাজনৈতিক সূত্রের খবর, দু–এক দিনের মধ্যে আরও পাঁচ থেকে ছয়জন বিধায়ক পদত্যাগ করতে পারেন। এই কয়েক দিনে যেসব বিধায়ক বিজেপি ছাড়লেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ‘অন্য অনগ্রসর’ (ওবিসি) অথবা ‘মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড’ (এমবিসি) শ্রেণিভুক্ত। শুধু তা–ই নয়, পদত্যাগের পরেই তাঁরা হাজির হচ্ছেন প্রথম দলত্যাগী ‘ওবিসি’ নেতা স্বামীপ্রসাদ মৌর্যের কাছে। বিজেপির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তিনি শুরু করেছেন।

    এবারের ভোটে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) নেতা অখিলেশ যাদবের নাম। আর অখিলেশ যাদবের দলে তাঁদের যোগদানের সম্ভাবনা প্রবল। আজ শুক্রবার এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

    রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত নেতাদের এই গণদলত্যাগের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে এক অমোঘ প্রশ্ন। তবে কি ভারতের বৃহত্তম রাজ্যে বিজেপির ‘কমন্ডুল’-এর রাজনীতির বিরোধিতায় নতুন করে গড়ে উঠতে চলেছে ‘মণ্ডল’ রাজনীতি, যে রাজনীতি উত্তর প্রদেশের বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতা মান্ডারাজ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে আশির দশকের শেষে দিল্লির মসনদে বসিয়েছিল।

    এই প্রশ্ন ওঠার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আর সেগুলো হলো বিজেপি-ত্যাগীদের সবাই রাজ্যের ‘ওবিসি’ এবং ‘এমবিসি’ নেতাই শুধু নন, ‘মণ্ডল’ রাজনীতি তাঁদের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো তাঁদের প্রত্যেকের ইস্তফাপত্রের বয়ানও এক, যেখানে বিজেপি আমলে বর্ণহিন্দুদের হাতে অনগ্রসর সমাজের ‘চরম উপেক্ষার’ কথা অভিযোগের সুরে লেখা।

    Also Check :  অমিক্রন এখনো দ্রুত ছড়াচ্ছে

    শুধু অনগ্রসর গোষ্ঠীর নেতারা নন, ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরাও বিজেপির ‘ঠাকুর’ (ক্ষত্রীয়) মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ওপর ক্ষুণ্ন। রাজ্য পরিচালনার সব ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘ঠাকুরবাদী’ মনোভাবের অভিযোগ নিয়ে বহুদিন ধরেই সরব তাঁরা। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অভিযোগও করেছেন বহুবার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের বারবার বদল করা হলেও আদিত্যনাথকে টলানো যায়নি। ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা আদিত্যনাথের ওপর অসন্তুষ্ট হলেও জাত হিসেবে বা দলগতভাবে অনগ্রসরদের মতো তাঁরা চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি। আর এ বিষয়ে ক্ষোভের আঁচ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব টের যে পাননি তা নয়। নানাভাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনগ্রসর উপমুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্য মারফত ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করেও তাতে আদিত্যনাথের ‘ঠাকুরবাদে’ রাশ টানা যায়নি। এ ছাড়া গত চার-পাঁচ মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর যাবতীয় প্রচেষ্টা যে বিফলে গেছে, আজকের ‘অনগ্রসরদের’ বিদ্রোহ তারই প্রমাণ।

    আর এই নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ থেকেই উঠে এসেছে ‘মণ্ডল’ রাজনীতির নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার প্রশ্নটি। ‘মণ্ডল’ রাজনীতির জনক বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে নতুন অবতারে আবির্ভূত হতে হয়েছিল। কংগ্রেস ত্যাগ করে গড়ে তুলতে হয়েছিল জনমোর্চা। তাঁর ‘মণ্ডল’ রাজনীতির পাল্টা হিসেবে উঠে এসেছিল বিজেপির কমন্ডুলের রাজনীতি, লালকৃষ্ণ আধভানির হাত ধরে। বিজেপির সাফল্যও সেই প্রবাহে। এবার সেই রাজনীতির পাল্টা হিসেবে জোরালো হচ্ছে ‘মণ্ডল’ রাজনীতি। বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণি জোটবদ্ধভাবে নতুন ধারার এই রাজনীতি শুরু করেছেন। উত্তর প্রদেশে এই রাজনৈতিক চমক শেষ পর্যন্ত কাকে হাসাবে আর কাকে কাঁদাবে, আপাতত তা নিয়েই জাতীয় রাজনীতি গমগম করছে। গত সাড়ে সাত বছরে এই দ্রোহ বিজেপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

    Also Check :  অর্থ ও মাদকে ‘ক্রিসমাস ট্রি’ সাজিয়ে এখন ফাঁসতে হচ্ছে

    এবারের এই নবরূপী ‘মণ্ডল’ রাজনীতির নেতৃত্বে নতুন কোনো নেতা নেই। আছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সমাজবাদী পার্টির (এসপি) নেতা অখিলেশ যাদব। উত্তর প্রদেশের জাতপাত–নির্ভর রাজনৈতিক প্রবাহে মুসলমান ও যাদবের (অনগ্রসরদের মধ্যে অগ্রবর্তী) মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন বাবা মুলায়ম সিং। অখিলেশ নিজেও এই জোটের সুফল ভোগ করে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তা থেকে সরে এসে এই প্রথম তিনি দলের ক্যানভাসকে বড় করে তুললেন।

    হিন্দুত্বের সঙ্গে সব জাতকে মেশাতে যে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বা সামাজিক মেলবন্ধন মোদি-অমিত শাহ জুটি ২০১৭ সাল থেকে সফলভাবে করে এসেছেন, তাতে ঘা মারতে অখিলেশ এবার অনেক আগে থেকে নিজেকে তৈরি করেছেন। কৃষক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি আঁচ করে জোটে টেনেছেন পশ্চিম–উত্তর প্রদেশের জোটভিত্তিক দল রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা জয়ন্ত চৌধুরীকে। বিজেপি ছেড়ে আগেই বেরিয়ে আসা পূর্বাঞ্চলীয় অনগ্রসর নেতা সুহেল দেব ভারতীয় সমাজ পার্টির নেতা ওমপ্রকাশ রাজভরের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছেন।

    ২০১৭ সালের ভোটে রাজভরের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বিজেপি। আটটি আসনে লড়াই করে রাজভরের দল চারটিতে জিতেছিল। পূর্ব–উত্তর প্রদেশের কিছু অঞ্চলে এই দলের ভোট রয়েছে ৭ থেকে ১২ শতাংশ। স্বামীপ্রসাদ মৌর্য তাঁর দলে যোগ দিলে অখিলেশের জোট হয়ে দাঁড়াবে ‘যাদব+মুসলমান+জাট+ওবিসি+এমবিসি’। জাতভিত্তিক আরও ছোট ছোট দল, যাদের বিজেপি কাছে টেনেছিল, তাদের কেউ অখিলেশের গড়া ‘রংধনু জোটে’ শামিল হওয়া আশ্চর্যের হবে না। ‘মণ্ডল’ রাজনীতির বিকাশ এভাবেই দ্রুত ঘটে।

    বিজেপির কাছে এটা অবশ্যই একটা বড় ধাক্কা, অপ্রত্যাশিতও। কারণ, প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় এমন বিদ্রোহ যে আঘাত হানবে তা বিজেপির ধারণার বাইরে ছিল। তবে নির্বাচনের আগে এমন ধাক্কা সামলাতে বিজেপিও কোমর বেঁধে মাঠে নামছে। ইতিমধ্যে দিল্লিতে দুদিনের বৈঠকে ঠিক হয়েছে দলত্যাগের প্রভাব ঠেকাতে আরও বেশি করে অনগ্রসর প্রার্থী করা হবে নির্বাচনে। সে জন্য উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিজেপি হিন্দুত্বকেও বড় করে তুলে ধরতে চলেছে। এ জন্য গোরক্ষপুরের কেন্দ্র ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অযোধ্যা থেকে প্রার্থী করার চিন্তাভাবনা করছে ভারতের ক্ষমতাসীন দলটি।

    Also Check :  Why Garena Stock Is Down In Last 4-5Days ?

    বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের আছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আবেদন অনস্বীকার্য। তার সঙ্গে যোগ করুন হিন্দুত্ববাদকে। সব জেলায় রয়েছে প্রবল সাংগঠনিক উপস্থিতি। ভোট করানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব দক্ষতাও আমাদের আছে। সরকারি কর্মসূচির সুফল যা সাধারণ মানুষ পেয়ে আসছেন, তার প্রভাবও কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্যের মানুষ জানেন, একমাত্র বিজেপিই পারে পাঁচ বছরের জন্য এক স্থিতিশীল সরকার দিতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা ঠিক, আমরা ধাক্কা খেয়েছি। কিন্তু সামলে নেব।’

    অখিলেশের হাত ধরে উত্তর প্রদেশে ‘মণ্ডল’ রাজনীতির প্রত্যাবর্তন কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা অনেকটা নির্ভর করছে অখিলেশের নেতৃত্ব ও দলের মানসিকতার ওপর। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ আজ যে ‘ঠাকুরবাদের’ অভিযোগে অভিযুক্ত, একটা সময় মুলায়ম-অখিলেশের দল এসপির বিরুদ্ধেও সেই অভিযোগ ছিল। এর কারণ ছিলো রাজ্য পরিচালনায় অত্যধিক যাদব ও মুসলমান নির্ভরতার। যাদব প্রাধান্য ‘ওবিসি’-ভুক্ত ছোট ছোট দলকে বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়তে সাহায্য করেছিল ওই কারণে। বিজেপিকে রুখতে এই মানসিকতার বদল অখিলেশ কতটা ঘটাতে পারেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আপাতত বলা যায়, উত্তর প্রদেশে ‘মণ্ডল-কমন্ডুল–এর লড়াই টানটান।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    x